গণঅভ্যুত্থান থেকে বিএনপি যেভাবে বারবার লাভবান হয়েছে

গণঅভ্যুত্থান থেকে বিএনপি যেভাবে বারবার লাভবান হয়েছে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনীতির বাঁক বদল ঘটেছে, তার সবগুলোতে দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সাল, ১৯৯০ সাল এবং ২০২৪ সালে।

এসব গণঅভ্যুত্থানের একটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন, আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে এবং আরেকটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থান এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে, এবং বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিভিন্ন সময়ে এসব গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত তুলে ধরা হলো যেখানে বিএনপি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বা তার প্রেক্ষিতে সুবিধা অর্জন করেছে:

১. ১৯৭৫-এর পরবর্তী ঘটনা এবং বিএনপির উত্থান:

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। সামরিক শাসন এবং ক্ষমতার পরিবর্তনের মাঝে ১৯৭৭ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। সামরিক শাসনের প্রভাব থাকলেও, গণমানুষের সমর্থন আদায়ে বিএনপি সফল হয় এবং গণআন্দোলনের মতো জনসাধারণের সমর্থন কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসে।

২. ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান:

১৯৯০ সালে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণআন্দোলন শুরু হয়, যার ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বিএনপি এই গণঅভ্যুত্থান থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এ আন্দোলনে অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয় এবং গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন।

৩. ২০০১ সালের নির্বাচন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা:

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিএনপি বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল। এ সময় বিভিন্ন গণ-আন্দোলন এবং রাজনৈতিক সংঘাতের মাধ্যমে বিএনপি আবারও নিজেদের জনসমর্থন বৃদ্ধি করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসে এবং খালেদা জিয়া পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন।

৪. ২০০৬-২০০৮ সালের রাজনৈতিক সঙ্কট এবং সেনা সমর্থিত সরকার:

২০০৬ সালে রাজনৈতিক সঙ্কট এবং নির্বাচন নিয়ে সংঘাতের মধ্যে সেনা সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘাত এবং আন্দোলন চলছিল। যদিও এই সময় বিএনপি সরাসরি লাভবান হয়নি, তবুও এই অস্থিরতা রাজনৈতিকভাবে তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে সহায়তা করে।

৫. বর্তমান সময়ে গণআন্দোলন:

২০২৪ সালের ৫ই অগাস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তারা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দখলে চলে গেছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে পালিয়ে বেড়ানো কিংবা মামলায় জর্জরিত থাকা বিএনপি নেতারা এখন আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

৫ই অগাস্টের পরে বেশ দ্রুততার সাথে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করের রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা জেল থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকের বিরুদ্ধে কিছু মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য বিবৃতি শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে।

মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এসব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষনিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।

উপসংহার: গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে ‘ফ্যাসিবাদের’ তুলনা করেছে বিএনপি। ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাবার পরে বিএনপির দেয়া ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা অনেকেই ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।

“এখনকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে, ” বলেন সাঈদ ইফতেখার আহমেদ।

মি. আহমেদ বলেন, ১৯৭৫ সাল এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক হিসেবে উপস্থিতি হয়েছে জনগণের সামনে। এর রাজনৈতিক সুবিধা খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বরাবর বিএনপিকেই দেখেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে যদি আরেকটি কার্যকরী শক্তি থাকতো তাহলে বিএনপি হয়তো বা এই সুবিধা পেতো না।

“বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাথে কোন ফারাক নেই। তাদের মধ্যে অমিল আছে, আবার অনেক মিলও আছে,” বলছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ।

তবে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নতুন কোন শক্তি আবির্ভূত হলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটি এখনই বলা মুশকিল।

 

 

One thought on “গণঅভ্যুত্থান থেকে বিএনপি যেভাবে বারবার লাভবান হয়েছে

Comments are closed.